সৃজনশীলে ‘কাঁচা’ শিক্ষকরাই
সৃজনশীলে ‘কাঁচা’ শিক্ষকরাই

সৃজনশীলে ‘কাঁচা’ শিক্ষকরাই

বিডি নিউজ ৬৪: আট বছর আগে দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হলেও শিক্ষকরা এখনো তা আত্মস্থ করতে পারেননি। প্রশ্ন প্রণয়ন কিংবা উত্তরপত্র মূল্যায়নের সক্ষমতাও অর্জন করতে পারেননি তাঁরা। সৃজনশীল পদ্ধতির ওপর এখন পর্যন্ত যথাযথ প্রশিক্ষণও পাননি সব শিক্ষক। এতে শিক্ষার্থীদের যথাযথ পাঠদানে ব্যর্থ হচ্ছেন তাঁরা। আর তাতে শিক্ষার্থীদের একটি প্রজন্ম গুণগত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত তাদের কোচিং কিংবা বাজারের নোট-গাইডের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। সৃজনশীল না বোঝায় অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকরাই গাইড বইয়ের শরণাপন্ন হচ্ছেন। ফলে পরীক্ষায় কোনো রকমে জিপিএ ৫ জুটলেও শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় গণহারে ফেল করছে।

সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে সাক্ষাৎকারভিত্তিক একটি প্রতিবেদন সম্প্রচার করে। তাতে জিপিএ ৫ পাওয়া অনেক শিক্ষার্থীই ‘জিপিএ ৫’ বলতে কী বোঝায়, সে প্রশ্নের জবাব দিতে পারেনি। এমনকি জাতীয় স্মৃতিসৌধ কোথায়, দেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি কে, কিংবা জাতীয় সংগীতের রচয়িতা কে—এসব প্রশ্নেরও ঠিকঠাক জবাব মেলেনি তাদের কাছ থেকে। এ অবস্থা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক শিক্ষাসচিব ড. সা’দত হুসাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, “জাতি এখন উদ্বিগ্ন হয়ে সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত শিক্ষাব্যবস্থা দেখছে। শিক্ষার মান সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিমজ্জিত। সবচেয়ে সর্বনাশ হয়েছে আমাদের মূল্যায়ন পদ্ধতি বা পরীক্ষাব্যবস্থার। নতুন পদ্ধতির নামে না বুঝে বিদেশি পদ্ধতি আধাআধি প্রয়োগ করে পরীক্ষাকে প্রহসনে পরিণত করেছি। পড়াশোনা ছাড়াই পরীক্ষার্থীরা পাস করে যাচ্ছে, ‘এ প্লাস’ পাচ্ছে। এখন দেখা যাচ্ছে, ‘এ গ্রেড’ পাওয়া পরীক্ষার্থীদের আসলে পরীক্ষা পাসের ন্যূনতম যোগ্যতাও নেই। উচ্চতর ক্লাসে ভর্তি পরীক্ষায় সে শতকরা শূন্য থেকে বড়জোর ১০ পাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগে ভর্তি পরীক্ষায় মাত্র ২ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করেছে।”

একই বিষয়ে অভিভাবক সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নীপা সুলতানা বলেন, সৃজনশীল পদ্ধতিটি খারাপ না। কিন্তু প্রয়োগটা ঠিকমতো হচ্ছে না। শিক্ষকরাই এখনো এ পদ্ধতি বুঝে উঠতে পারেননি। ফলে তাঁরা যথাযথভাবে পাঠদান করতেও পারছেন না। যার কারণে শিক্ষার্থীরা অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হচ্ছে। এর খেসারত ভবিষ্যতে শুধু বর্তমান প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদেরই নয়, সবাইকেই দিতে হবে।

‘রিসার্চ ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব কমপ্লিট এডুকেশন’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে এখনো অভ্যস্ত হতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। বিষয়ের পরিমাণও বেড়েছে। সে অনুযায়ী শিক্ষকরা  শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পর্যাপ্ত সময়ও পাচ্ছেন না। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাবও রয়েছে। সেই ঘাটতি পূরণে অভিভাবকরা সন্তানের কথা বিবেচনা করে গৃহশিক্ষক ও কোচিং সেন্টারের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছেন।

সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়নে সক্ষম নয় মাধ্যমিকের অর্ধেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারেই মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় অর্ধেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়নে সক্ষমতা অর্জন করতে পারেননি। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, এখনো দেশের ১৮.৭৬ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘বাজারি’ বা ‘রেডিমেড’ প্রশ্নে পরীক্ষা নিচ্ছে। ২৮.৩৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন করেন অন্য বিদ্যালয়ের সহায়তায়। আর নিজেদের প্রশ্নে পরীক্ষা নিতে পারে ৫১.০৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠান। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের অ্যাকসেস অ্যান্ড কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স ইউনিটের (একিউএইউ) করা গত ফেব্রুয়ারির সুপারভিশন প্রতিবেদনে এ চিত্র ফুটে উঠেছে। ওই মাসে দেশের ১৮ হাজার ৫৯৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে সাত হাজার ২৭৬টি প্রতিষ্ঠান সুপারভিশন করা হয়েছে।

মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রতি মাসে নিয়মিত মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সুপারভিশন করে প্রতিবেদন তৈরি করেন। জেলা শিক্ষা অফিস ও মাউশির আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে প্রণীত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এই সমন্বিত সুপারভিশন প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে।

ফেব্রুয়ারির প্রতিবেদন অনুসারে, সুপারভিশন করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নিজস্ব শিক্ষকরা সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন করেন, এমন বিদ্যালয়ের সংখ্যা তিন হাজার ৭১৪টি (৫১.০৪ শতাংশ)। শিক্ষকরা অন্য বিদ্যালয়ের সহায়তায় সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন করেন, এমন বিদ্যালয়ের সংখ্যা দুই হাজার ৬২টি (২৮.৩৪ শতাংশ)। বাইরে থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করে, এমন বিদ্যালয়ের সংখ্যা এক হাজার ৩৬৫টি (১৮.৭৬ শতাংশ)।

‘বাজারি’ প্রশ্নে পরীক্ষা গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা আমলে নিচ্ছে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : ‘বাজারি’ প্রশ্নে পরীক্ষা গ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে প্রায় আড়াই বছর আগে। নিয়ম অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে এমপিও (বেতনের সরকারি অংশ) বাতিল করা হবে বলেও ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে তা আমলে নিচ্ছে না কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারি অফিস আদেশ জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংগৃহীত প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেওয়া নিষিদ্ধ করে। একই বছরের মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আরেক অফিস আদেশে বলা হয়, যেসব স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা সৃজনশীল প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারে না তাদের চিহ্নিত করে এমপিও বাতিল করা হবে। তবে আজ পর্যন্ত কারো এমপিও বাতিল হয়নি। পরিস্থিতিরও কোনো উন্নতি হয়নি।

অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, বাড়ছে গাইড ও কোচিংনির্ভরতা : যেসব শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারেন না, তাঁরা নতুন এ পদ্ধতিতে পাঠদানে কতটা সক্ষম তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। জানা গেছে, যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবেই শিক্ষকদের সক্ষমতায় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে আট বছর আগে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হলেও এখনো দেশের অর্ধেকের বেশি শিক্ষক নতুন পদ্ধতির ওপর প্রশিক্ষণই পাননি। নতুন পদ্ধতির আলোকে পাঠ্যবই তৈরি হলেও এ বিষয়ে সহায়তায় জন্য শিক্ষকদের যে টিচার্স গাইড দেওয়ার কথা, তাও দেওয়া হয়নি।

গত ফেব্রুয়ারিতে যে সাত হাজার ২৭৬টি প্রতিষ্ঠানে সুপারভিশন হয়েছে সেগুলোতে কর্মরত রয়েছেন এক লাখ ১৩ হাজার ৭২৭ জন শিক্ষক। এর মধ্যে সৃজনশীল প্রশ্নের ওপর প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ৫৭ হাজার ৩২৭ জন শিক্ষক। অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি শিক্ষক এখনো কোনো প্রশিক্ষণই পাননি।

গত ২৬ মে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষার মান উন্নয়নবিষয়ক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছিল। এতে অংশ নেওয়া বিশিষ্টজনরা সৃজনশীল পদ্ধতির সংস্কারের দাবি জানান। এ পদ্ধতি প্রবর্তনের পক্ষের অন্যতম ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘শিক্ষকরাই সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন করতে পারছেন না। ফলে তাঁরা গাইড বই অনুসরণ করছেন।’

সৃজনশীল পদ্ধতি প্রচলনের পক্ষে শুরু থেকেই সোচ্চার অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনিও স্বীকার করেছেন, অনেক শিক্ষকই ‘সৃজনশীল প্রশ্নের মাথামুণ্ডু কিছুই ধরতে পারছেন না’।

মাউশির সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের (এসইএসডিপি) সাবেক পরিচালক রতন কুমার রায় জানান, কোনো পদ্ধতি প্রবর্তনের সময়ই সব শিক্ষককে ধরে ধরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। প্রকল্পের আওতায় প্রথমে মাস্টার ট্রেইনারদের ১২ দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা জেলা পর্যায়ে শিক্ষকদের তিন দিনের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। স্কুল পর্যায়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের বাকিরাও যদি এটি শিখে নেন, তাহলে তারাও নিজ নিজ বিষয়ে প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারবেন।

শিক্ষকদের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে তার যথার্থতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তিন দিনের ওই প্রশিক্ষণ নেওয়া একজন শিক্ষক নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ‘মাত্র তিন দিনের প্রশিক্ষণে একটি নতুন বিষয় আত্মস্থ করা কিভাবে সম্ভব? আসলে কোনো একাডেমিক ট্রেইনিংই হয়নি। কেবল সৃজনশীল বিষয় সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেওয়া হয়েছে, বিষয়ভিত্তিক পড়ানো বা প্রশ্ন করানো কিংবা খাতা মূল্যায়নের বিষয়টি শেখানোর মতো সময়ই ছিল না। যে ট্রেনিং হয়েছে তা দিয়ে শ্রেণিকক্ষে ছাত্রছাত্রীদের বোঝানো কঠিন।’

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক সমিতির আহ্বায়ক মো. মোফাজ্জাল হোসেন বলেন, ‘এমনিতেই দেশে শিক্ষকদের মানোন্নয়নের জন্য সত্যিকার অর্থে উন্নতমানের কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। এই অবস্থায় সৃজনশীল প্রশিক্ষণের নামে চলছে হরিলুট। প্রশিক্ষণে জড়িত কর্মকর্তারা সবাই কলেজের লোক, মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পর্কে তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, অথচ তাঁরাই সৃজনশীলের কর্মকর্তা। প্রশিক্ষকদের ধারণা কম থাকায় একজন শিক্ষক তিন দিনের প্রশিক্ষণে কী অর্জন করবেন তা সহজেই অনুমান করা যায়।’ তাঁর মতে, মাধ্যমিক শিক্ষার মানের ধসের জন্য শিক্ষকরা ১০ শতাংশ দায়ী, ৯০ শতাংশ দায়ী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যকর না হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও। গত ২৮ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উদ্দেশে দেওয়া নোটে তিনি বলেছেন, ‘শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিষয়ে বর্তমানে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। তাই প্রশিক্ষণ বিষয়ে একটি কার্যকর পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। না হলে এ প্রশিক্ষণ শিক্ষার মানোন্নয়নে কার্যকর কোনো অবদান রাখতে পারবে না এবং দৃশ্যমান কোনো উন্নতি হবে না।’

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবে শিক্ষকরাও গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। একজন শিক্ষার্থী একটি গাইড বই কিনলেও একজন শিক্ষক একই বিষয়ের জন্য পাঁচ-সাতটি করে গাইড কিনছেন। প্রশ্নপত্র প্রণয়নের সময় একটি প্রশ্নের একেক অংশ একেক গাইড থেকে তুলে দিচ্ছেন তাঁরা। ক্লাসে যথাযথ পাঠ না পেয়ে শিক্ষার্থীরাও গাইডেই আশ্রয় খুঁজছে। পাশাপাশি সকাল-সন্ধ্যা কোচিংয়ে দৌড়াতে হচ্ছে।

গণিত নিয়ে সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতিতে রয়েছে শিক্ষার্থীরা। এ বিষয়ে এত দিন শিক্ষকদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়নি। সম্প্রতি গণিতের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।

রাজধানীর কয়েকটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্ন কিভাবে আসবে, তা তারা বুঝে উঠতে পারছে না। শ্রেণিকক্ষে বিষয়গুলো তাদের কাছে পরিষ্কার হচ্ছে না। তা ছাড়া ক্লাসের যে সময়সীমা তাতে শিক্ষকরাও কোনো একজন শিক্ষার্থীর পেছনে আলাদা মনোযোগ দিতে পারেন না। ফলে পাঠ্য বিষয়গুলো অস্পষ্টই থেকে যাচ্ছে। ফলে মূল বইয়ের পুরো অধ্যায় না পড়ে গাইডে দেওয়া নির্দিষ্ট উত্তর শিখেই পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে।

বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তৃতীয় শ্রেণি থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের সব বিষয়ের বইয়ের গাইড বই পাওয়া যাচ্ছে। সেগুলোয় সৃজনশীল পদ্ধতি অনুসরণ করে মূল বইয়ের প্রতিটি অধ্যায় উত্তরসহ সংযুক্ত করা হয়েছে। ফলে পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্নের বিপরীতে গাইড থেকে মুখস্থ করে আসা উত্তরই হুবহু লিখছে শিক্ষার্থীরা। ফলে মেধা কিংবা সৃজনশীলতার চর্চা হচ্ছে না।

সৃজনশীল পদ্ধতি কী : ২০০৮ সাল থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। মুখস্থ-নির্ভর পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তে উদ্দীপক ও দৃশ্যকল্প ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ, উচ্চতর চিন্তন দক্ষতা মূল্যায়ন উপযোগী প্রশ্নপদ্ধতিকে সাধারণভাবে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি বলা হয়।

মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতে, কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন পদ্ধতিকে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। অর্থাৎ পরীক্ষার প্রশ্নগুলো একটা কাঠামোর মাঝে করা হবে। তাঁর ভাষায়, ‘মুখস্থ করার ক্ষমতাটি কোনো কিছু শেখার মূল ক্ষমতা নয়। শুধু মুখস্থ জ্ঞান পরীক্ষা করাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এমনভাবে প্রশ্ন করতে হবে যেন আমরা জানতে পারি ছেলে বা মেয়েটা বিষয়টি আসলেই বুঝেছে কি না, বিষয়টি ব্যবহার করতে পারে কি না কিংবা বিষয়টি নিয়ে একেবারে নিজের মতো করে চিন্তা করতে পারে কি না। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিটি আসলে এ বিষয়টি নিশ্চিত করে।’

সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাঠ্য বইয়ে যে মূলপাঠ রয়েছে তার থেকে প্রশ্ন না করে তারই মূলভাবের আলোকে বাইরের দৃষ্টান্ত নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। সেই দৃষ্টান্ত থেকে জ্ঞানমূলক, অনুধাবন, প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতা—এ চারটি স্তরে বিন্যাস করে প্রশ্ন করা হয়। শিক্ষার্থীরা মূলপাঠের দৃষ্টান্ত অনুসরণে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকে। আগে মূলপাঠ থেকে পাঠ্য বইয়ে প্রশ্নপত্র থাকত। শিক্ষকরা পরীক্ষার সময়ে তা দেখে প্রশ্ন তৈরি করতেন। কিন্তু এখন নমুনা প্রশ্ন থাকে মাত্র একটি। পাঠ বিশ্লেষণ করে বাইরে থেকে প্রশ্ন করার কারণে সময় নিয়ে উদ্দীপক (এক ধরনের দৃষ্টান্ত) তৈরি করতে হয়, যা অনেকটা সময়সাপেক্ষ ও পরিশ্রমসাধ্য।

২০০৮ সালে মাধ্যমিক পর্যায়ে সৃজনশীল পদ্ধতি প্রবর্তনের পর ২০১০ সালে শিক্ষা বোর্ডগুলো এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রণয়ন শুরু করে। ২০১২ সাল থেকে এইচএসসিতে সৃজনশীল প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়া শুরু হয়। এত দিন এসএসসি ও এইচএসসিতে কোনো বিষয়ে ১০০ নম্বরের মধ্যে ৪০ নম্বর এমসিকিউতে এবং ৬০ নম্বর বরাদ্দ থাকত সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির জন্য। তবে ২০১৭ সাল থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় এমসিকিউ ১০ নম্বর কমিয়ে সৃজনশীল প্রশ্ন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।

কর্তৃপক্ষের ভাষ্য : শিক্ষকরা যে সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারছেন না, সে কথা স্বীকার করলেন মাউশি অধিদপ্তরের সদ্য সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুনও। তবে তিনি বলেন, নতুন পদ্ধতি হিসেবে বাস্তবায়নে সময় লাগছে। তা ছাড়া কোনো কোনো শিক্ষকের মান এতই নিম্ন যে তাঁরা প্রশিক্ষণ নেওয়ার যোগ্যতাও রাখেন না। তিনি ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে জানান, পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়ন ও মডারেশনে শিক্ষকের সংকট প্রকট। পরিস্থিতি এমন যে এসএসসির প্রি-টেস্ট ও টেস্ট পরীক্ষার প্রশ্ন পর্যন্ত বোর্ড থেকে করে দিতে হয়েছে। অথচ এসব প্রশ্ন স্কুলপর্যায়ে তৈরি করার কথা।

কেনা প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়ার পরও কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘শিক্ষা আইন না থাকায় তা আমরা করতে পারছি না। আইনি বিধান না থাকায় এমপিও বাতিল করলেও সংশ্লিষ্টরা আদালতের আশ্রয় নিয়ে তা ফেরত পেয়ে যায়।’

অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন জানান, শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে ইনহাউজ ট্রেনিংয়ের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি এলাকায়ই এখন এমন শিক্ষক রয়েছে, যারা ১২ দিনের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাদের নিয়ে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বছরে তিন-চারবার ইনহাউজ ট্রেইনিংয়ের ব্যবস্থা করতে আমরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাগিদ দিচ্ছি।’

মাউশি অধিদপ্তরের মাধ্যমিক শাখার পরিচালক এলিয়াছ হোসেন বলেন, সব শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়নি, এটা সত্য। তবে কোনো শিক্ষকই বসে নেই। প্রশিক্ষিত সহকর্মীর সহযোগিতাসহ নানা উপায়ে তাঁরা নিজেদের প্রস্তুত করার চেষ্টা করছেন। এক পদ্ধতিতে অভ্যস্ত শিক্ষক আরেক পদ্ধতিতে গেলে পারফরম্যান্স সমান থাকবে না, এটা অস্বাভাবিক নয়। বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে। সব শিক্ষকের প্রশিক্ষণ দিতে পারলে সমস্যা থাকবে না। তা ছাড়া সৃজনশীল পদ্ধতিতে যারা লেখাপড়া করে বের হচ্ছে তারা যখন শিক্ষকতায় আসবে তখন সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *