সবাই ভেবেছে আর নেটফ্লিক্স করে দেখিয়েছে । পর্ব-১ । আসিফামি রহমান সৈকত

সবাই ভেবেছে আর নেটফ্লিক্স করে দেখিয়েছে
পর্ব-১
আসিফ রহমান সৈকত
১।খুব কম লোকই এটা ভাবতে পেরেছিলো যে নেটফ্লিক্সের কোনো টিভি সিরিজ ২০১৩ সালে এমি এওয়ার্ড জিততে পারবে , কিন্তু সেটা হয়েছিলো । ডেভিড ফিঞ্চ এর হাউজ অফ কার্ডস টিভি সিরিজ পরিচালনার জন্য এমি এওয়ার্ড পান। নেটফ্লিক্সের ব্যবসা শুরু হয়েছিলো ১৯৯৮ সালে , ডিভিডি ভাড়া দেবার মাধ্যমে , এবং সেটা তারা করতো মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করে। বাংলাদেশে আমরা ৯০ দশকের কথা মনে করতে পারি , তাদের হয়তো খেয়াল আছে , ভিডিও ক্যসেটের রমরমা ব্যবসা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকেই হুলস্থুল পড়ে যেতো নতুন সিনেমা নেবার জন্য। তখন ক্যবল ব্যবসা ছিলো না। সেটা শেষের দিকে এসেছিলো । বলিউড আর হলিউডের সিনেমা, বা বাংলা সিনেমার পাইরেটেড কপির প্রচুর চাহিদা ছিলো। দেখা যেতো শাহরুখ-সালমানের ছবি অনেক দোকান ৪-৫ কপি করে প্রিন্ট করতো যাতে ভাড়া দিয়ে টাকা উঠাতে পারে তাড়াতাড়ি। আর হলিউডের ছবি তো ছিলোই, সেগুলো ছিলো আমাদের সিনেমা দেখার মূল সোর্স । যদিও প্রায়ই প্রিন্ট অনেক খারাপ থাকতো। তাও তা ছিলো মন্দের ভালো। নেটফ্লিক্স এই ধরনের ডিভিডির ব্যবসাটাই , পরে আমেরিকার ক্যবল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বা ইন্টারনেট অনলাইনের মাধ্যমে স্টিমিং করতো , প্রথমে মাসিক ভিত্তিতে ভাড়া দেবার মাধ্যমে , পরে স্ট্রিমিং এর সুযোগে, আমেরিকাতে অবশ্য অনেক সিনেমাই ডিভিডি প্রিন্ট বাজারে পাওয়া যেতো সঠিক মূল্যে। ইন্টারনেট এর প্রসারের সাথে সাথে এই স্ট্রিমিং টাকে , এই ডিজিটাল নেটওয়ার্ক, ডাটাবেইস, বিগ ডাটা এনালাইসিস, ডাটা মাইনিং , দর্শকের সিনেমা দেখার অভ্যাসের বিশ্লেষণের উপর অনেক গুলো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো নেটফ্লিক্স, যার মধ্যে একটা হলো , প্রতি সপ্তাহে একটা করে পর্ব রিলিজ দেবার পরিবর্তে একটা সপ্তাহে পুরো সিজনের সব পর্ব রিলিজ দিলো , কোনো টিভি সিরিজের। ছুটির দিনের একটা পরিবারের পুরোটা একেবারে দখল করে নিলো নেটফ্লিক্স , ছুটির দিনের ব্যবসার উপর অনেকেই অপেক্ষায় থাকে, বিনোদনকেন্দ্রগুলো, সিনেমা হল, টিভি সবাই; সবার জায়গাটা নিয়ে নিয়েছে নেটফ্লিক্স , এমনকি হলে গিয়ে সিনেমা দেখা অথবা বন্ধুদের বাইরের আড্ডা , ঘরে চলে এসেছে, খাবার নিয়ে, খাটে শুয়ে, সোফায় বসে, ফেসবুক , ওয়াটসএপ এ চ্যট করতে করতে , এ এক নতুন বিনোদনের অভিজ্ঞতায় মানুষকে নিয়ে আসলো নেটফ্লিক্স।এটা নতুন যুগ। এটা সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্ত এবং ব্যস্ত মানুষের জন্য আদর্শ আরেক বিনোদন মাধ্যম এবং আমি বলবো অবশ্যই ইউটিউব থেকে হাজার গুণ ভালো।কারণ ইউটিউবে যদু-মধু-কদু যে ইচ্ছা, যা ইচ্ছা উঠাইতে পারে, যা ইচ্ছা দেখাইতে পারে, একজন সারাদিন বসে বসে ভাত খাচ্ছে এই ভিডিও হয়ে যেতে পারে শীর্ষ ভিডিও , কোনো কারণ ছাড়াই, গুণগত মান দেখার , পরীক্ষায় কোনো উপায় নাই ইউটিউবে । ভালো ভিডিওর জায়গা আছে, অনেক কিছুই আছে। কিন্তু খারাপ ভিডিওর সংখ্যা সেখানে ৩-৪গুণ বেশি হবে, এতে কোনোই সন্দেহ নাই।এতো ফ্রি ফ্রি বলে , সবাইকে যা ইচ্ছা তা , মিথ্যা তথ্যের ভিডীও বানানোর সুযোগ দিয়ে, আরো বিরক্ত করে তুলেছে দর্শককে ( আসলে ফ্রি বলে কিছুই নাই, একটা কথা আছে, যখন কেউ বলে ফ্রি , বুঝবেন, আপনে নিজেই আসলে পণ্য হয়ে যাচ্ছেন তার, ইউজার / ব্যবহারকারী, ভিডিও আপলোডকারী নিজেই আসলে ইউটিউবের পণ্য , ইউটিউব যাকে প্রতিদিন বিক্রি করে , যেখানে সেখানে, যখন-তখন। নেটফ্লিক্স আবার এই মান পরীক্ষা, মান দেখা এমনকি নিজেই এখন নির্মাণের সাথে , প্রযোজনার সাথে সরাসরি জড়িত। নেটফ্লিক্সের ভালো সিনেমার , টিভি সিরিজের সংখ্যা, সারা পৃথিবীর , বিভিন্ন ভাষায় অজস্র, সেই দিক থেকে নেটফ্লিক্স হলো কোনো দেশের নয় আসলে, পুরো পৃথিবীর যেকোন জায়গার সেরা কাজগুলোর স্বীকৃতির একটা জায়গা এটা এখন। এটা কোনো দেশের টিভি চ্যনেল না, কোনো মহাদেশের না। এটা এই দুনিয়ার একটা টিভি চ্যনেল হয়ে গেছে, যেখানে মানুষ মাসিক একটা টাকা দিয়ে ১০ ডলারের বেশি বা একটা পেমেন্ট দিয়ে ৫ টা একাউন্ট এর মালিক হয়ে ল্যপটপ, টেলিভিশন, মোবাইলে কনটেন্ট দেখার এক বিশাল মাধ্যম। এবং বর্তমানের সবচেয়ে জনপ্রিয় বিনোদন, শিক্ষা আর তথ্যের মাধ্যম। এতে কোনো সন্দেহ নাই। আরো অনেকে এসেছে , কিন্তু নেটফ্লিক্স হলো পথিকৃত । নেটফ্লিক্স হলো শীর্ষে। এর পেছনে আছে মেধা, প্রযুক্তি , উন্নতমানের কনটেন্ট এবং সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার লোকজন। এতে কোনো সন্দেহ নাই।



২। টেলিভিশনের সত্যিকারের ভবিষ্যত হিসাবে প্রশংসিত হয়েছে , নেটফ্লিক্স , সেটা এখন প্রমাণিত এবং “হলিউডের জন্য সবথেকে ভীতিকর” , টেলিভিশনের স্বর্ণযুগের সমাপ্তির সত্যিকার আভাস এবং ছোট ছোট অনুষ্ঠান, অপ্রয়োজনীয় খবর, টক শো , অপেরার বিরক্তিকর অবস্থা আর বিজ্ঞাপনের ভয়াবহ প্রচারের ঠেলায় , নেটফ্লিক্সের অবস্থান আরো দৃঢ় আর শক্তিশালী হয়েছে। মানুষ উলটো টাকা দিয়ে নেটফ্লিক্স দেখছে। এবং প্রযুক্তিগত কারণে , ইন্টারনেটের কারণে, আইপি এড্রেস আর স্টোরেজের অভাবনীয় উন্নতির ফলে এই খরচ ও অনেক অনেক কমে গেছে।

৩। ভিডিও স্ট্রিমিং টা কি আসলে? ইউটিউবেও যেটা হয় সেটাও তো তাই। একই জিনিস। কিন্তু এলগরিদম আর টেকনোলজির আরো ভালো ব্যবহারে , নেটফ্লিক্সের মান অনেক অনেক ভালো। আবার অনেক সময় টেলিভিশন বা ডিভাইসের মধ্যেই সে আগে থেকে স্ট্রিমিং এর একটা স্টোর করে রাখে, ধরেন, ১০ মিনিটের ভিডিও , ২ মিনিট আগেই স্টোর করে তারপর চালায় , ২ মিনিট যখন চলতে থাকে , তখন ব্যকগ্রাউন্ডে বাকি ৮ মিনিট আসতে থাকে , তাই আপনি আর বুঝতে পারেন না যে ভিডিও আসতে দেরি হয়েছে কি হয় নাই। তারপরেও আপনার ইন্টারনেট কানেকশন স্পিড তো সবসময়ই জরুরী বিষয় কিন্তু সেটার জন্য তারা বিভিন্ন ফরমেট বা ওজনের ( মেগা বাইটের হিসাবে হতে পারে ) ভিডিও তে উঠানামা করে, বা সেভাবে বুঝে তারা সম্প্রচার করে। আরেকটা দারুণ ব্যপার হলো , ব্যবহারকারীর সাথে সম্পর্ক রেখে তারা তার রুচির সাথে যায় এমন ভিডীও কে প্রাধান্য দেয়, কোনো পর্বের যেখানে শেষ করলো , পরবর্তীতে ঠিক তারপর থেকে শুরু করে, এতে একসাথে অনেকে ৩-৪ টা বিভিন্ন টিভি সিরিজদেখে , একসাথে বিভিন্ন স্বাদের, আর দর্শককেও মনে রাখতে হয় না কোথায় কতোটুকু দেখেছিলাম, এটা বিশাল জরুরী একটা পদক্ষেপ , এই সুবিধা দর্শক আগে কখনোই পায় নাই। ধরেন, কোনো দর্শক একটা ডকুমেন্টারি দেখছিলো, এর মধ্যে তার বাচ্চা এনিমেশন ফিল্ম দেখতে চাইলো, দর্শক সেখানে চলে গেলো, বাচ্চার দেখা শেষ হলে বা ঘুমিয়ে পড়লে , ঠিক সেই জায়গা থেকে দর্শক আবার ডকুমেন্টারি দেখা শুরু করলো । নেটফ্লিক্স এই এলগরিদমগুলো ভালো ভাবে ব্যবহার করে। দেশভিত্তিক বা অঞ্চলভিত্তিক বা ভাষাভিত্তিক বিশ্লেষণ তারা করে , সেইভাবে সেটা আবার দর্শককে জানায় যে বাংলাদেশে এখন বক্স বার্ড সিনেমাটা সবাই দেখছে। স্বভাবতই তখন অনেকেই সেইটাকেই দেখে। দর্শকের সাথে এতো বেশি ইন্টারেক্টিভ আর কোনো মাধ্যম আগে ছিলো না। আর দর্শকও এই সুবিধার জন্য মাসে ১২০০ টাকা বা এই রকম আলাদা ৫ জন নিলে ২০০-৩০০ টাকা খরচ করতে একটুও বিরক্ত হয় না, মাত্র ২০০ টাকা , এই ২০২০-২০২১ সালে একটা জায়গাতে সি এন জি তে গেলেই তো ২০০ টাকা শেষ , সেই টাকা দিয়ে সারা মাস সারা পৃথিবীর সেরা সেরা টিভি সিরিজ, সিনেমা , ডকুমেন্টারি দেখার ব্যপারটা আসলে , দর্শকদের কাছে কিছুই না। আর নেটফ্লিক্সের জায়গা থেকে দেখুন। বাংলাদেশ ১ লাখ লোক এর ও যদি ১০ ডলারের সংযোগ থাকে , তার মানে ২০ লাখ ডলারের বাজার , ২০লাখ ডলার মাসিক আয়, মানে ৮৫ টাকা ও যদি হয়ে ১ ডলারের দাম তাহলেও ১৭ কোটি টাকা!!!বিজ্ঞাপনের কি আসলেই কোনো দরকার আছে নেটফ্লিক্সের। সারা পৃথিবীর দর্শক যেখানে তাকে টাকা দিচ্ছে। সারা পৃথিবীতে যে টাকাটা বিজ্ঞাপন বানানোর কাজে ব্যবহার হতো তাও এখন সিনেমা , টিভি সিরিজের , ডকুমেন্টারির জন্য ব্যবহার হচ্ছে। এটা তো একদিক থেকে দারুণ। ভালো কনটেন্ট এর সংখ্যাও কিন্তু বাড়ছে।মেধা থাকলেই কেউ জায়গা করে নিতে পারছে পৃথিবীতে। কারণ সবার দর্শক হলো পুরো দুনিয়ার দর্শক এখন। বাংলাদেশের মানুষও এখন স্প্যনিশ , জার্মান , তুর্কি, কোরিয়ান, হিন্দী, তেলেগু, তামিল , মালায়লাম, জাপানী, চাইনিজ সব ভাষার সিনেমা, ডকুমেন্টারি দেখছে। দিন শেষে যারা ডাউনলোড করে, হার্ড ডিস্কে সিনেমা জমাতো তারাও এই ঝামেলা থেকে সরে এখন ভিডীও স্ট্রিমিং এর দিকেই যাচ্ছেন। কারণ আসলে হার্ড ডিস্কে নামানো থাকলেই কিন্তু সিনেমা দেখা হয় না, সেটা অনেকেই জানি, আর এর পেছনে অনেক অনেক ঘন্টা সময় নষ্ট হয়। সময়টা কিন্তূ সব থেকে দামী, মূল্যবান। টাকার মূল্য এর থেকে অনেক কম। টাকা থেকে যাবে , কিন্তু সময় একদিন শেষ হয়ে যাবে। এই দর্শনটাও কিন্তু কাজে লাগে বলে আমার ধারণে এই ভিডীও স্ট্রিমিং এর ক্ষেত্রে। কারণ নেটফ্লিক্স এর কনটেন্ট ভালো হয়, এই গুণগত জায়গাটা দর্শককে একটা স্বস্তি দেয়। ভালো কনটেন্ট খোজার সময় ব্যয় করার ব্যপারটা থেকে মুক্তি দেয়।


ইংরেজীতে সবাই এখন কিছু কথা ব্যবহার করে যেটা নেটফ্লিক্সের কারণে প্রচলিত হয়েছে একটা হলো বিঞ্জ-ওয়াচিং আরেকটা হলো কর্ড কাটিং । টিভিতে কোনো টিভি সিরিজের পর্ব গুলো টানা দেখাকে বিঞ্জ-ওয়াচিং বলছে সবাই, এটা একটা নতুন দেখার স্টাইল তৈরি হয়েছে, আগে যেটা হতো ,অনেকে ডাউনলোড করে তারপর সেটা একটার পর একটা দেখতো সিজন ধরে ধরে, পুরো সপ্তাহ একটা সিরিজ নিয়ে থাকতো। সেটা এখন নেটফ্লিক্সের কারণে টিভিতেই করতে পারছে। আরেকটা হইলো কর্ড কাটিং, মানে তুমি ভালো কিছু দিচ্ছো না, তো এই মাসে আর তোমারটা দেখলাম না, চলে গেলাম এমাজন প্রাইমে বা হইচই এ বা আই-ফ্লিক্স এ। সেটা একদিক থেকে ভালো হয়েছে ভালো কনটেন্ট যারা তৈরি করেন তাদের জন্য, কারণ নেটফ্লিক্সরাও চায় ভালো কনটেন্ট দিয়ে তাদের দর্শক ধরে রাখতে কারণ দর্শক মানেই তাদের টাকা আসছে, আর ভালো কনটেন্ট নির্মাতাও দরকষাকষি করতে পারছে এবং ভিডিও স্ট্রিমিং সাইটগুলো নিজেরাই নিজেদের স্বার্থে ভালো কনটেন্ট তৈরির জন্য বিনিয়োগ ও করছে। তাই সব দিক থেকেই তো ভালো হচ্ছে এটা। সত্যিকারের জবাব্দিহিতা তৈরি হচ্ছে, দর্শক , নির্মাতা আর নেটফ্লিক্সের মধ্যে ভারসাম্য ও আসছে। যাই দেখাইবা তাই দেখিতে হইবে, এই জায়গা থেকে দর্শক মুক্তি পাচ্ছে, খারাপ নির্মাতারা জোর কে কিছু দেখাতে বাধ্য করতে পারছে না, যেমন বাংলাদেশের অনেক চ্যনেল বা সব চ্যনেল সবাই মিলে খারাপ নাটক বানালেও আমাদের এর বাইরে তো দেখার সুযোগ নাই। সেই জায়গাটাই আর নাই।আর বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণা থেকেও সব পক্ষই মুক্তি পেয়েছে। এখন সরাসরি কনটেন্ট, নাটক, টিভি সিরিজ, মুভিটাই হলো পণ্য যেটা দর্শক পয়সয়া দিয়ে দেখে।
আর দর্শকরা বলে , নেটফ্লিক্স দেখো আর ফূর্তি করো ।

এটাতো এখন প্রায়ই শোনা যায়, দোস্তরা , আসো , নেটফ্লিক্স দেখি আর চিল করি এই চিল ইংরেজী চিল।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *