সবাই ভেবেছে আর নেটফ্লিক্স করে দেখিয়েছে।পর্ব-২ . আসিফামি রহমান সৈকত

সবাই ভেবেছে আর নেটফ্লিক্স করে দেখিয়েছে। আসিফামি রহমান সৈকত
পর্ব-২

 



৪।নেটফ্লিক্সের কারণে দর্শক আর নির্মাতার বিজ্ঞাপন থেকে মুক্তি , নতুন ভাবে টিভি সিরিজ নিয়ে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে নির্মাতা এবং দর্শক কেও। দেখা গেছে, পর্ব গুলো যতোক্ষন দরকার ততোক্ষণ ধরে এগিয়ে রাখা গেছে। প্রথম পর্ব ১ ঘন্টা , পরের পর্ব ৫০ মিনিট , কোনো পর্ব ৪০ মিনিট করা গেছে, দর্শক এটা নিয়ে চিন্তিত না, কারণ সে জানে ৮-১৩ পর্ব তার কাছে আছে , একটা শেষ হবে তো আরেকটা শুরু হবে। সে আসলে পুরো সিজন নিয়ে ভাবে , পর্ব নিয়ে অতোটা না। আর নির্মাতাও দিন শেষে গল্পটা নিয়ে আরো বেশি করে ভাবার, আরো বেশি ফুটেজ দেয়ার অবকাশ পান। বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণা থেকে দর্শক এবং নির্মাতা দুই পক্ষই মুক্তি পান। আর এটা সম্ভব হয় নেটফ্লিক্সের পরিকল্পনার কারণে, যেখানে দুই পক্ষই টাকা দিয়ে এবং টাকা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে , এর মধ্যে থেকেই নেটফ্লিক্স তার লাভ বের করে আনে। অনেকেই টাকা দিয়ে টিভি দেখার কথা বলে, সেই চেষ্টা হয়েছেও অনেক বার , কিন্তু ইন্টারনেট এর কারণে , অনলাইন পেমেন্টের অগ্রগতির কারনে এই জায়গাটাতে নেটফ্লিক্স তার অবস্থান তৈরি করে নিতে পেরেছে। তবে অবশ্যই এখানে বিনিয়োগের ব্যপার তো ছিলোই।



নেটফ্লিক্স তিনটা জিনিসের বুঝার ব্যপারের সাথে জড়িত
টেলিভিশন প্রযুক্তির পড়াশুনা
ইন্টারনেট প্রযুক্তির সক্ষমতা বুঝার ব্যপার এবং
তথ্য নিয়ে গবেষণা , যার সাথে তথ্য সংগ্রহ , ডাটাবেজ তৈরি , বিশ্লেষণ, বিগ ডাটা , ডাটা ওয়ারহাউজ এবং মাইনিং এর বোঝাপড়াটা যুক্ত ভালোভাবেই।এগুলোর কোনো একটি ছাড়া আজকের নেটফ্লিক্স হয় না।
তথ্যকে নিয়ে খেলার যে প্রক্রিয়া সেটাই আজকের দুনিয়ায় নিউ মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ার চাবিকাঠি। কি ভাবে সেই খেলাটা হবে সেটার নিয়মটাই হলো এলগরিদম। এটা হলো যুক্তির কাঠামো দাড় করানো যার ফলে সংক্রিয় ভাবে কম্পিউটার তার প্রসেসিং সক্ষমতা এবং তথ্য , ডাটা জমানোর আর বিশ্লেষণের মাধ্যমে দ্রুত সঠিক একটা সিদ্ধান্ত দিতে পারে। যা মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব এবং সময় সাপেক্ষ। মানুষের দ্রুত হিসাব করার অক্ষমতা এবং বিলিয়ন বিলিয়ন , কোটি কোটী তথ্য মাথার মধ্যে জমা রাখার অক্ষমতাটাকে , প্রসেসর আর মেমোরি , সমাধান করে দিয়েছে।
এলগরিদমের এই ব্যবহার আর কিছু লজিক বা যুক্তির উপর দাঁড়িয়ে দর্শককে উপদেশ বা সিদ্ধান্ত দেবার ক্ষমতা , নেটফ্লিক্স কে করেছে , অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আর যুগটাও কিন্তু জরুরী, যে যুগে ইন্টারনেট সবার কাছে, মোবাইল সবার কাছে, ল্যপটপ অনেক সহজ লভ্য, ইন্টারনেট টিভির দাম মানুষের নাগালের মধ্যে। তাই বলা যায়, পুরো মঞ্চ সাজানো এখন নেটফ্লিক্সের জন্যই।ইন্টারনেট দিয়ে দুনিয়ার যেকোন প্রান্তে নেটফ্লিক্স ও তার মালামাল নিয়ে চলে যেতে পারে ক্রেতার কাছে , তার বিনোদনের খোরাক যোগাতে। কেউ আটকাতে পারবে না, পারে না, সম্ভব আটকানো কিন্তু সহজ নয় তা।
নেটফ্লিক্স সাংস্কৃতিকে বুঝার চেষ্টা করে, প্রযুক্তিকে বুঝার চেষ্টা করে, সেই ভাবে সিদ্ধান্ত নেয়। সেইসব দক্ষ লোকের হাতেই গড়তে থাকে তার সাম্রাজ্য। এটা বিজ্ঞানের জায়গা, মেধা-মননের জায়গা, প্রযুক্তির বুঝার জায়গা। মেধাকে কাজে লাগানোর , তাকে স্বীকৃতি দেবার জায়গা। মেধাবীদের যেই দেশে দাম নাই, সেই দেশের বা সেই এলাকার মানুষের দ্বারা নেটফ্লিক্স হবে না, অনুকরণ হতে পারে, তারপরেও হবে না। হচ্ছে না , সেটা দেখতেই পাচ্ছি, ২০ কোটি লোকের দেশ , ৩৫ কোটি বাংগালীর বাজার থাকার পরেও , বাংলাদেশ কি এখনো কোনো জায়গাতে আসতে পেরেছে , হইচই প্ল্যটফর্ম তো এই এলাকায় সবার উপরে , বাংলাদেশ কেনো পারে নি? উত্তর সবার ই জানা।কোনো কিছু তৈরি করার থেকে আমদের আমদানি-রপ্তানিতে আগ্রহ বেশি।

৫। ২০১৬ সালেই দুনিয়ার ১৩০ টা দেশে নেটফ্লিক্স চলে গেছে তার ব্যবসা নিয়ে, এবং সেইসব দেশের দেশীয় অনুষ্ঠান , সিনেমা , নাটককেও তারা প্রাধান্য দিচ্ছে। তাই আন্তর্জাতিক আর এলাকাভিত্তিক, ভাষাভিত্তিক দুই জায়গাতেই তারা গুরুত্ব দিয়ে সামাল দিচ্ছে। এতে দর্শকও খুশি থাকছে।
সম্প্রতি করোনাকালে বিভিন্নদেশে অনলাইনে ফিল্ম ফেস্টিভাল হচ্ছে, সেখানে শুধু সেই দেশের দর্শকের জন্য কিছু চলচ্চিত্র উন্মুক্ত রাখা হয়েছে , যেটা আমরা বাংলাদেশ থেকে দেখতে পাবো না। সেটা কিভাবে করা হচ্ছে? কারণ আইপি ব্লক , আইপি এড্রেস , যেটা প্রতিটা সার্ভার বা ল্যপটপ বা ইন্টারনেট সার্ভিস যারা দেয় তাদের প্রতিটা ডিভাইস বা স্টোরেজ এর দেয়া আছে, সেটা দেখে বলে দেয়া যায় যে , ওই আইপি টা কোন জায়গা বা দেশ থেকে আসছে, অনেকটা মোবাইলের মতো ; মোবাইলে নাম্বার দেখে অবস্থান বলা যায় টাওয়ার এর কারণে, তার থেকে আরেকটু জোরালো স্ট্রাকচার এ বুঝা যায় , একটা আইপি কোন দেশ থেকে আসছে। তাই বাংলাদেশ থেকে যখন জার্মানির কোনো ফিল্ম ফ্যস্টিভালে অনলাইনে সিনেমা দেখতে যায়, তখন তারা বলে ,তোমার দেশে এটা দেখানো যাবে না। তখন চোরাই পথে , অন্য দেশের আইপি দিয়ে এটা অনেকে দেখার চেষ্টা করে, এটা এভাবে হয় যে, ধরেন ভারতে থাকলে দেখা যাবে, তাহলে এমন একটা উপায় বের করতে হবে যে, বাংলাদেশ থেকে ভারতে হয়ে জার্মানিতে সিনেমাটা দেখা যাবে। এটা অনেকে করে ভিপিএন দিয়ে। নেটফ্লিক্স এই ভিপিএন দিয়ে আসা ব্যপারটাও আলাদা , শক্তভাবে পর্যবেক্ষণ করে, যার কারণে ,কোনো টিভি সিরিজ যদি সৌদি আরবে নিষিদ্ধ হয় বা সেখানকার আইন অনুযায়ী দেখার অযোগ্য হয়, তাহলে সেটা নেটফ্লিক্স ঠিকই নিয়ন্ত্রণ করে। নইলে সৌদি আরবের আইন অনুযায়ী , সেখানে নেটফ্লিক্স ব্যবসা করতে পারবে না। তথ্য প্রযুক্তিবিদ প্রকৌশলী, বিজ্ঞানীদের ভালো দল ছাড়া এই কাজ করতে পারতো না তারা। এইখানেই নেটফ্লিক্সের শক্তি।
তার উপর টরেন্টে, কোনো অবৈধ সাইটে, ইউটীউবে কেউ তাদের সিনেমা পরিবেশন করছে কিনা সেটার জন্য সার্বক্ষনিক টিম কাজ করে। এটা নেটফ্লিক্সের অস্তিত্বের জন্যই জরুরী , এবং আরেকদিক দিয়ে দর্শক এবং নির্মাতাদের জন্যই জরুরী, নইলে টাকাটা চুরি হয়ে যাবে, আর নেটফ্লিক্সের মতো ভিডিও স্ট্রিমিং চ্যনেল বন্ধ হলে, উন্নত , ভালো মানের টিভি সিরিজ, সিনেমা ও দেখা বন্ধ হয়ে যাবে।
৬। নেটফ্লিক্সের একটা মজার ব্যপার হলো সে দুই নৌকাতেই পা দিয়া রাখসে। টেলিভিশনেও হাত দিসে, সিনেমাতেও নাক গলাচ্ছে। এই জায়গাতে তার অবস্থান দৃঢ় আর দর্শক ও একজায়গাতেই দুইটা জগত পাইয়া ব্যপক খুশি। তার উপর আবার টিভি সিরিজ, সিনেমা, ডকুমেন্টারি জমা রাখছে অনলাইনে, দর্শকরাও জমা অংশ থেকে বেছে নিতে পারছে, যেটা টিভি বা সিনেমাতে পারতো না তারা। এক জায়গাতেই সব কিছুর মজা নিচ্ছে , ল্যপটপে সিনেমা রাখার যে মজা সেটাও। তাহলে আর কি চাই !!! আগের সব মিডিয়াকে এক জায়গায় আনতে পেরেছে, ডিজিটাল আর ইন্টারনেট প্রযুক্তির কারণে , সাথে আবার ভিন্ন ভিন্ন ইন্ডাস্ট্রীকেও একই প্লাটফর্মে নিয়ে আসছে। এইটা তো মানুষের স্বপ্নই ছিলো বলা যায়।
তাহলে আসেন তালিকা করি , কি কি কারণে নেটফ্লিক্সের এই বিজয়ঃ
১।ইন্টারনেট এর শক্তিটা বুঝা
২। ডিজিটাল মিডিয়াকে কাজে লাগানো , যা সহজলভ্য এবং সস্তা , তুলনামূলকভাবে
৩। মানুষের চাহিদাটাকে বুঝার চেষ্টা করা
৪। যার যার এলাকার সাংস্কৃতিকে বুঝা এবং সেই অনুযায়ী সেখানে টীভি সিরিজ বা সিনেমা দেখানো
৫। নিজেই দর্শকদের তথ্য বিশ্লেষণ করে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া। টি আর পি তথ্য নেবার থেকে আই পি থেকে কে কি দেখছে সেই তথ্য অনেক বেশি সহজে , এলগরিদমের জায়গা থেকেই হিসাব করতে পারে , কে কি দেখে, কতোক্ষণ দেখে, কোন সময় দেখে বা কোন অনুষ্ঠানের পর কোনটা দেখে ইত্যাদি। সেই হিসাবে সঠিক অনুষ্ঠানের প্রচার এবং নির্মাণে সঠিক সিদ্ধান্তটা তারা নিতে পারে।
৬। মোবাইল, ল্যপটপ, ইন্টারনেট , স্মার্ট টিভির যুগটা অনেক সক্রিয় এখন , যা নেটফ্লিক্সের উত্থানকে সহজ করেছে আরো। আগে ছিলো তথ্যের অভাবের সমস্যা , এখন হলো অতিরিক্ত তথ্য থাকাটা একটা সমস্যা যেটা তথ্য না থাকার থেকে বেশি বিপদজনক এবং সময় নষ্টকারী।দর্শক ও এই জায়গা থেকে বেচে থাকতে চায়।
আগে ছিলো টাইপরাইটার , মাইক্রোসফট ওয়ার্ড আসাতে সেটা হইলো আধুনিক, স্মার্ট টাইপ্রাইটার, নেটফ্লিক্স অনেকটা এই রকমই । টিভির জায়গা থেকে, সিনেমার জায়গা থেকে স্মার্ট একটা সমাধান সে , দর্শকদের জন্য। নেটফ্লিক্স নিজে আসলে পুরনো ব্যপারগুলোই নতুন করে আরো আরামদায়ক এবং সহজে গ্রহণযোগ্য জায়গাতে নিয়ে আসলো। নেটফ্লিক্স নিজেই এখন একটা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান, ফিল্ম স্টুডীও, বাসা বাড়িতে বিনোদনের সরবরাহকারী, অনলাইনে ইন্টারনেট আর্কাইভ ,যেখানে থেকে দর্শক যখন খুশি আঙ্গুর-আপেল নামাইয়া খাইতে পারে, সিনেমা, টীভি সিরিজ, ডকুমেন্টারি, কার্টুন , এনিমেশনের আর্কাইভের জায়গা।দর্শক এক জায়গাতে দশ জায়গার আরাম পাইলে , আর কোথায় কেনো যাবে? হোম থিয়েটারের মতো বিশাল বিশাল মনিটর বা টিভি বা প্রজেক্টর এর কারণে বাসাতেই সিনেমাহলের আনন্দ পাচ্ছে মানুষ। এটাতো এখন নিয়মিত ব্যপার হয়ে গেছে যে হলে আসা সিনেমা দুই তিন সপ্তাহের মধ্যেই আগে টিভিতে যাইতো , এখন নেটফ্লিক্সে বা অন্য ভিডিও স্ট্রিমিং সাইটে আসে, যদি কনটেন্ট ভালো হয়।এটাতো এখন এলাকার সবাই জানে। বিনোদনের মাধ্যম এবং উপাদানের দুই জায়গাতেই নেটফ্লিক্স সফল।কারোই এখন আর এটাকে অস্বীকার করার, এড়াবার কোনো উপায় নেই। দর্শক হিসাবে কিন্তু আমি আনন্দিত। সারা দুনিয়ার ভালো কাজগুলো আমার বাসায় যেকোন সময় আমি দেখতে পারি, আমরা দেখতে পারি।এটা তো একধরনের স্বাধীনতাই আমার জন্য।



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *