‘প্রবাসীদের রেমিটেন্সের পরিমাণ পোশাক খাতকে ছাড়িয়ে গেছে’

বাংলাদেশের রেমিটেন্স প্রবাহ টিকে আছে প্রবাসীদের ওপর, বিশেষ করে প্রবাসী শ্রমিকদের ওপর৷ কিন্তু তাঁদের জন্য সরকার কী করছে? কেমন আচরণ, সুবিধা পাচ্ছেন তাঁরা? উত্তরে নানারকম উদ্যোগের কথা বলা হলেও, বাস্তব কিন্তু বলছে অন্য কথা৷
‘অল এয়ারপোর্ট ম্যাজিস্ট্রেট’ নামে একটা ফেসবুক পেজ আছে৷ পেজটি খুবই তৎপর৷ চাইলে এখানে অভিযোগ করা যায়, আবার প্রতিকারের খবরও জানা যায়৷ সেই পেজে মীর রবিউল করিম নামে এক প্রবাসী বাংলাদেশি লিখেছেন, ‘দীর্ঘ ২৭ বছরের প্রবাস জীবনে যতবার দেশে গেছি, এয়ারপোর্টের অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা মানসিক কষ্টের কারণ হয়েছে৷ একবার ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়িয়ে আছি৷ আমার সামনের মানুষটির পকেটে জোর করে হাত ঢুকিয়ে দেয় ইমিগ্রেশন পুলিশ৷ কেড়ে নেয় টাকা৷ আমি প্রতিবাদ করতেই আমার দিকে তেড়ে আসে পুলিশ৷ কিন্তু আমার ক্যানাডিয়ান পাসপোর্ট থাকায় সুবিধা করতে না পেরে সটকে পরেন৷ মানুষটির আকুতি এখনও আমার মনকে আঘাত করে…৷ তাঁর বিদেশি পাসপোর্ট ছিল না৷ সে ছিল প্রবাসী শ্রমিক৷’
এই পেজেই পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম একটি পোস্ট দিয়েছিলেন গত ৪ঠা মে৷ লিখেছিলেন, ‘বিদেশে বাংলাদেশের কোনো এম্ব্যাসি বা হাইকমিশনে অফিস সময়ের মধ্যে ফোন করে পাননি বা কাঙ্খিত সেবা পাননি – এই ধরনের সুনির্দিষ্ট (তারিখ, সেবার ধরণ এবং সম্ভব হলে যে ব্যক্তির সাথে আপনার কথা হয়েছে – এ সব সহ) অভিযোগ থাকলে তা আমাকে [email protected] – এই ঠিকানায় ই-মেল করে দয়া করে জানান৷’
এই দু’টি পোস্ট প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি আচরণ বুঝতে যথেষ্ট৷ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিজেই জানেন যে, বিদেশে বাংলাদেশি দূতাবাসগুলো প্রবাসীদের সেবা দেয় না৷ এমনকি খোঁজ-খবরও নেন না তারা৷ এই ফেসবুক পেজে প্রবাসীদের এ রকম আরো অনেক অভিযোগ আছে৷ বাংলাদেশের শাহজালাল বিমানবন্দরে কোনো প্রবাসীর সব হারানোর খবরও আছে৷ আছে এয়ারপোর্ট ম্যাজিস্ট্রেটদের সহয়াতায় উদ্ধারের খবর, আছে প্রবাসীদের ধন্যবাদের খবর৷ এই ফেসবুক পেজটি যেন এখন প্রবাসীদের বাস্তব অবস্থা জানার একটি ডিজিটাল মাধ্যমে পরিণত হয়েছে৷
মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে কাতারে, বাংলাদেশের নারী গৃহকর্মীদের দুর্দশা আর দাসজীবনের খবর প্রায়ই প্রকাশ পাচ্ছে৷ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম হয়ে এখন তা বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমেও পাওয়া যাচ্ছে৷ এরইমধ্যে ৫০ ভাগ নারী গৃহকর্মী কোনো না কোনোভাবে সেইসব দেশ থেকে ফেরত এসেছেন৷ কেউ এসেছেন পালিয়ে, কেউ আবার অন্যদের সহায়তায়৷ তবে বাংলাদেশি দূতাবাসের সাহায্য তাঁরা পাননি৷ এমনকি দূতাবাসের কাছে ঘেষতেও পারেননি৷

প্রবাসী বাংলাদেশি কত?
বাংলাদেশের প্রাবাসী নাগরিক কত তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই৷ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) বলছে, এ পর্যন্ত ৯৫ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক বিভিন্ন দেশে কাজ নিয়ে গেছেন৷ তবে ঠিক কতজন শ্রমিক ফেরত এসেছেন আর বর্তমানে কতজন বিদেশে অবস্থান করছেন, সে হিসাব কোনো সংস্থার কাছে নেই৷
শ্রমিক ছাড়াও বাংলাদেশের অনেক নাগরিক ইউরোপ-অ্যামেরিকাসহ উন্নত বিশ্বে উচ্চ পদে কাজ করছেন, ব্যবসা করছেন, করছেন গবেষণা এবং পড়াশুনা৷ সেই হিসেবে এক কোটি ২০ লাখ বাংলাদেশি এখন প্রবাস জীবনযাপন করছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে৷
জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত না হলেও, মোট জিডিপির প্রায় ৮ শতাংশ অবদান রয়েছে রেমিটেন্সের৷ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১ হাজার ৫৩১ কোটি ডলার রেমিটেন্স এসেছে, যা মোট জিডিপির প্রায় ৮ শতাংশ৷ বিএমইটি-র তথ্য অনুসারে, ১৯৭৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট ৯৫ লাখ ৭০ হাজার ১১২ জন শ্রমিক মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং ইউরোপ, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে চাকরি নিয়ে গেছেন৷
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরবে ২৬ লাখ ৭৭ হাজার ৪৩৬, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২৩ লাখ ৪৯ হাজার ৬৭২, কুয়েতে ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৬১২, ওমানে ১০ লাখ ৪৬ হাজার ৫১, কাতারে ৪ লাখ ৪৯ হাজার ২৫, বাহরাইনে ৩ লাখ ১৫ হাজার ১২৪, ইরাকে ৩৬ হাজার ৭৯৫, লেবাননে ১ লাখ ২৯ হাজার ৩৪২ ও জর্ডানে ১ লাখ ৩ হাজার ২৭০ জন বাংলাদেশি শ্রমিক হিসেবে গেছেন৷ এছাড়া আফ্রিকার লিবিয়ায় ১ লাখ ২২ হাজার ১২৫, সুদানে ৮ হাজার ৫১২, মিসরে ২১ হাজার ৮৯০ ও মরিশাসে ৪৩ হাজার ৯৮৪ জন বাংলাদেশি গেছেন শ্রমিক হয়ে৷ এছাড়া যুক্তরাজ্যে ১০ হাজার ৭০ ও ইটালি গেছেন ৫৫ হাজার ৫১৪ বাংলাদেশি শ্রমিক৷
এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে মালয়েশিয়ায় ৭ লাখ ১০ হাজার ১৮৮, সিঙ্গাপুরে ৫ লাখ ৮৫ হাজার ২৩৯, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৩৩ হাজার ১১৫, জাপানে ১ হাজার ৩৬৬, ব্রুনাইয়ে ৫১ হাজার ৩৪ এবং অন্যান্য দেশে ১ লাখ ১০ হাজার ২০৩ জন বাংলাদেশি বিভিন্ন কাজ নিয়ে গেছেন৷

প্রবাসীদের জন্য ঘোষিত সুবিধা
বাংলাদেশে প্রবাসীদের জন্য আলাদা একটি মন্ত্রণালয় আছে৷ এর নাম বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ষ প্রবাসীদের এই মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ১০ ধরনের সুবিধা দেয়ার কথা বলা হয়েছে৷
১. প্রবাসী আয় করমুক্ত, ২. বিদেশ যেতে রয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক অভিবাসন লোন, ৩. বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর পুনর্বাসন লোন, ৪. বিদেশ থেকে ফিরে কেউ কোনো ব্যবসায়িক প্রকল্প করতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক লোন, ৫. বিদেশে কোনো প্রবসী মারা গেলে লাশ দেশে আনার পর সরকার লাশ দাফনের জন্য ৩৫ হাজার অনুদান, ৬. মৃত ব্যক্তির পরিবারকে এককালীন ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত অনুদান, যা জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মাধ্যমে দেওয়া হয়ে থাকে, ৭. বিদেশে কর্মরত থাকাকালে নিয়োগকর্তা কর্তৃক কোনো প্রতারণা বা বঞ্চনার শিকার হলে, বেতন আটকে দিলে তা ঐ দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রমউইংয়ের মাধ্যমে সব ধরনের আইনি সহায়তা প্রদান, ৮. বিদেশে কেউ মারা গেলে লাশ পাঠাতে সব আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপারে সাহায্য, ৯. বাংলাদেশের সব ব্যাংকে প্রবাসীদের জন্য বিশেষ সুবিধা এবং ১০. ঢাকাসহ দেশের সব নামকরা অথবা যে কোনো স্কুল-কলেজ সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবাসীদের সন্তানদের ভর্তির জন্য বিশেষ কোটা৷

বাস্তকে কী সুবিধা পান প্রবাসীরা
অবশ্য এ সব সুবিধা তাঁরা কতটুকু পান তা নিয়ে আছে প্রশ্ন৷ প্রবসীদের দূতাবাসের মাধ্যমে আইনি সহায়তা পাওয়ার কথা থাকলেও, তা পাওয়া যায় না৷ আর লাশ দেশে ফেরত পাঠানো, ক্ষতিপূরণের টাকা, বিশেষ ঋণ – এগুলো কাগজেই আছে৷ বাস্তবে এর দেখা মেলা ভার৷ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর সামনে গেলেই চিত্রটি পরিষ্কার হয়৷ সেখানে প্রতিদিন শত শত মানুষ ভিড় করেন৷ তাঁদের মধ্যে বড় একটি অংশ হলো তাঁরা, যাঁরা বিদেশ থেকে ফেরত এসেছেন৷ এঁরাই ক্ষতিপূরণের টাকার জন্য মাসের পর মাস ঐ অফিসে ধরনা দেন৷
প্রবাসীদের সন্তানদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শতকরা একভাগ কোটার কথা বলা হলেও, বাস্তবে কিন্তু কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই এই নিয়ম মানে না৷ এখানেই শেষ নয়৷ বাংলাদেশে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক নামে একটি ব্যাংকের প্রক্রিয়া চললেও, তা এখনো তফসিলি ব্যাংক হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি৷ আর দু’টি এনআরবি (নন রেসিডেন্ট বাংলাদেশি) ব্যাংক কাজ শুরু করলেও, তারা এখনো সাধারণ ব্যাংকের মতোই কাজ করছে৷ তবে এখানে প্রবাসীরা বিনিয়োগ করছেন৷
জনশক্তি এবং অভিবাসন বিশ্লেষক হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রবাসীদের রেমিটেন্স পাঠানোর পরিমাণ এ বছর পোশাক খাতকেও ছাড়িয়ে গেছে৷ বাংলাদেশ সর্বশেষ পোশাক খাত থেকে আয় করেছে ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আর প্রবাসীরা রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার৷”
অথচ প্রবাসীদের জন্য সেই তুলনায় তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই, জানান তিনি৷ বলেন, ‘‘বাজেটে প্রবাসী কল্যাণে মাত্র ০.০২ ভাগ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে৷ নানা ধরনের পেশাজীবীদের সন্তানদের জন্য আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, কিন্তু প্রবাসীদের জন্য কিছু নেই৷”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *